মর্ডান হারবালের প্রতারণা ফাঁস
মর্ডান হারবালের ব্যবসার আড়ালে ধরা পড়েছে প্রতারণা। সুচতুর ডা. আলমগীর মতি প্রতারণার জাল বিস্তার করেছেননরাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দেশের বেকার যুবক-যুবতিদের নানাভাবে আকৃষ্ট করে ওই প্রচারণার ব্যবসায় সম্পৃক্ত করেছেন তিনি। আমার সংবাদ
ডাক্তার আলমগীর মতি কথিত হারবাল ওষুধের কোনো মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করে তা দীর্ঘদিন ধরে বাজারজাত করে আসছেন। আর এসব অভিযোগে গতকাল ভেজালবিরোধী অভিযানে আলমগীর মতির কারখানায় অভিযান চালিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এসময় ডাক্তার আলমগীর মতির প্রতিষ্ঠান মর্ডান হারবাল গ্রুপকে ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করে কারখানা সাময়িকভাবে সিলগালা করে দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাছগাছড়া, লতাপাতা ও ফলমূল দিয়ে তৈরি ওষুধে ভেজাল, বিস্ময়কর মনে হলেও সত্য।
হারবাল ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের সুনামকে কাজে লাগিয়ে ডা. আলমগীর মতিসহ নামধারী হেকিম ও কবিরাজ চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা করে যাচ্ছেন। দুর্নীতি অনিয়মসহ নানা কারণে ওষুধ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।এতে দেশের সাধারণ মানুষ ভয়ঙ্কর ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
অন্যদিকে, অনুমোদন ছাড়াই অনেকেই ভেজাল ওষুধ তৈরি করে দোকান বা বিভিন্ন সড়কের গলিতে ফ্ল্যাট নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন। দ্রুত ফল দেখাতে গিয়ে বিভিন্ন সময় হাঁপানির ওষুধে উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড, মোটা হওয়ার ওষুধে পেরিকটিন, যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধির ওষুধে সিলেন্ডা, সাইট্রেট, ভায়াগ্রা, সেনেগ্রা, ফর্সা হওয়ার ক্রিমে স্যালিসাইলিক এসিড, দাঁত পরিষ্কারে হাইড্রোক্লোরিক এসিড মেশানো হয়। এমনকি হারবাল ও আয়র্বেদিক ওষুধে আফিম ও মদ ব্যবহার হচ্ছে অহরহ। সেগুলোর অর্থ সাধারণ মানুষ জীবনেও শুনেননি।
এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নিয়ে রোগীদের রক্ষার্থে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। জানা যায়, গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় মর্ডান হারবালের কারখানায় অভিযান চালিয়ে ওই জরিমানা করা হয়।
অভিযানের নেতৃত্ব দেন র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী হাকিম সারোয়ার আলম। অভিযানে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের সারোয়ার আলম বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০০টি পণ্য বাজারে রয়েছে।
এসব পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, এর কোনোটিরই মেয়াদ নেই। কোম্পানির মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগারে (কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাব) অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, এখানে সাত, আট ও ৯ বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এমন রাসায়নিকও রয়েছে।
এমনকি কয়েক বছর ধরে প্রতষ্ঠানটি যেসব পণ্য উৎপাদন করেছে, তার কোনোটিরই ব্যাচ ম্যানুফ্যাকচারিং রেকর্ড (বিএমআর) নেই। একটি পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে যে ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, আর সেটার গুণগত মান যাচাই করা হয়েছে, কারা এসব পণ্য তৈরি করেছেন; সব তথ্য এই বিএমআরের মধ্যে থাকে।
আবার একই ল্যাবে খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। অথচ প্রতিষ্ঠানটি একই ল্যাবে এমনটাই করে আসছে। র্যাবের প্রশ্ন ছিল, আজকে যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করেছেন, সেগুলোর নমুনা কোথায়? তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তা দেখাতে পারেনি।
তারা জানান, কাগজে লেখা আছে। এখানে অভিযান শুরুর পর প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা তারিক বিন হোসেন ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সবকিছুরই মান নিয়ন্ত্রণ করেছি।
তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, এর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। কারা ষড়যন্ত্র করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাইরের কেউ করছে। সূত্র জানায়, মাদকদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ সারাদেশে ঠাণ্ডা-কাশির সিরাপকে নেশার বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে মাদকসেবীরা।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মর্ডান হারবালসহ কথিত হারবাল ল্যাবরেটরিতে এসব নেশা ও ভেজাল সিরাপ উৎপাদন করা হচ্ছে। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কোনো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এ ধরনের ওষুধ বা ভেজাল ইউনানি সিরাপ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করা হচ্ছে।
আর এসব কাশের সিরাপ খেয়ে অনেক শিশুসহ বয়স্ক লোকজনও মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসনের লোকজনের সহযোগিতায় এসব ইউনানি ল্যাবরেটরিতে সিরাপ ও নেশার সিরাপ তৈরি করা হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। আর মাদকসেবীরা এখন ডেক্সপোটেন সিরাপ, অফকফ, সুডুকফ, তুসকা, ফেনারগ্যান, ডায়ড্রিলসহ বিভিন্ন ঠাণ্ডা-কাশির সিরাপ বেশি খাচ্ছে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বহুলবাড়িয়া গ্রামে হারবাল ওষুধ পান করে এক শিশুসহ দুইজন মারা গেছে। এ ঘটনায় আরও একজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন।
নিহত শিশু রাজধানীর নবীন হারবাল ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত সিরাপ খেয়ে মারা গেছেন বলে অভিযোগে জানা গেছে। এ ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা গিয়ে ওই কারখানাটি বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু পরে নতুন মহাপরিচালক আসার পর পুনরায় তা খুলে দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে ওই কারখানাটি পুনরায় চালুর অনুমতি পেয়েছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী দক্ষিণ শেখদির ৪ নম্বর রোডস্থ ১০/১ নম্বর অধ্যক্ষ এরশাদুল্লাহ সড়কের বাড়িতে ওই ল্যাবরেটরি। চারপাশে নোঙরা পরিবেশ আর মাদকাসক্তদের ভিড় দেখা গেছে। কারখানার মালিক এস কে চৌধুরী ওরফে কাজল চৌধুরী।
তিনি ওই ভেজাল ও নেশার সিরাপের ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ওই কারখানায় হারবাল সিরাপসহ নেশার ওষুধ তৈরি করে সারা দেশেই সরবরাহ করে আসছিল।
এ ব্যাপারে ডাক্তার আলমগীর মতির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। তবে প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা তারিক বিন হোসেন বলেছেন, আমরা সবকিছুরই মান নিয়ন্ত্রণ করেছি।


কোন মন্তব্য নেই